-: ” #জার্মানি_রথে_চড়েন_মদন_গোপাল_জিউ ” :-
-: তিয়রবেড়িয়ার ৮০ মন পিতলের রথ :-
তৎকালীন সময়ের অখন্ড মেদিনীপুরের এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রথ যাত্রার ইতিহাস। ওই সময়ের একমাত্র বৃহৎ পিতলের রথ বলতে এই তিয়রবেড়িয়ার ৮০ মন পিতলের রথ। বর্তমানে জেলাও বিভক্ত এবং সেই সঙ্গে দিন দিন তাল মিলিয়ে বাড়ছে রথের সংখ্যা। যা কিন্তু পূর্বে ছিল কেবলমাত্র কয়েকটি হাতে গোনা চলুন আজ আসি মেদিনীপুরের সেই রথের ইতিহাস নিয়ে। মেদিনীপুর জেলায় পেতলের রথ কিন্তু আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। তিয়রবেড়িয়ার সামন্ত পরিবারের এই রথ আনুমানিক ১১২ বছরের প্রাচীন। জানা যায় ঘাটাল নিবাসী বলরাম সামন্ত তিয়রবেড়িয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি বন জঙ্গল থেকে কলাপাতা কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রথম পত্নীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয়বার বিবাহ হয়। দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত কলকাতার বড়বাজারে ভূষিমালের ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসায় ক্রমশ সফল হয়ে তিনি অর্থবান হলেন। পূর্ব মেদিনীপুরের মালিদা গ্রামের প্রায় একহাজার বিঘা জমি কেনেন। ব্যবসা ও তাঁর জমিদারীর প্রভাব বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। তিয়রবেড়িয়ার গ্রামেই এই সামন্ত পরিবারের পাশেই এক ব্রাহ্মণ পরিবার থাকতেন। তাঁদের কূলদেবতা কোষ্ঠী পাথরের কৃষ্ণ মূর্তি মদনগোপাল জিউ। সেই ব্রাহ্মণ পরিবার অর্থ কষ্টে কূলদেবতার পুজো চালাতে পারেননি। তখন সেই পুজোর দায়িত্ব নিলেন জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত। তারপর তিনি সেখানে অষ্টধাতুর রাধার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থাপন করলেন রঘুনাথ জিউ শালগ্রাম শিলা ও গড়ুরদেব। পরে এই জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ পেতলের রথ বানালেন। লোকমুখে তখন শোনা যেত ‘ #লঙ্কাবেচে_রথ_কিনলেন_ত্রৈলোক্যনাথ’ । আসলে কলকাতার ভূষিমাল ব্যবসাই তাঁর এত সম্পদ এনে দিয়েছিল। যদিও তিনি রথ করতে চেয়েছিলেন তাঁর জমিদারীর ভেতর তিয়রবেড়িয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম আড়খানাতে। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে রথ করলেন তিয়রবেড়িয়াতেই।
সামন্ত পরিবারের এই রথ প্রায় ৮০ মন পেতল দিয়ে বানানো। সুদূর #জার্মান থেকে আনা হয়েছিল পিতল। জার্মান কোম্পানির স্ট্যাম্পও এখনো লক্ষ্য করা যায় রথের গায়ে। জার্মান থেকে কলকাতা m, কলকাতা সম্পূর্ণ নৌ পথে ( গঙ্গা নদী হয়ে রূপনারায়ণ নদ হয়ে দূর্বাচটি নদী দিয়ে ) আনা হয় পিতল । এক কথায় বলা হয় ” #জার্মানি_রথে_চড়েন_কুলদেবতা ” । রথের পাঁচটি চূড়া যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। চূড়ায় লাল রঙের পতাকা সজ্জিত থাকে। মাঝের চূড়ার লাল রঙের পতাকার মাঝে হলুদ রংয়ের সুদর্শন চক্র আঁকা। তাই পতাকার নাম চক্রধর। মাঝের চূড়াতে একটি ঘন্টা রয়েছে। মাঝখানের চূড়ার মাথায় অধিষ্ঠিত গড়ুরদেব। রথের নাম গড়ুরধ্বজ। রথের উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। সামনে ২ টি পেতলের ঘোড়া। সারথী সাত্যকী। রথের ৬ টি চাকা, লোহার তৈরি যা ষড় রিপু দমনের প্রতীক। রথ টানার সময় ছটি চাকার যে চারটি দাগ পড়ে সেই দাগ হলো ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ।রথের উপর চারকোনের মন্দিরে ৪ জন ঋষি– গদাধর, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, অদ্বৈত আচার্যের মূর্তি। মাঝে কূলদেবতা মদনগোপাল জিউ ও রাধারাণী এবং শালগ্রাম সজ্জিত থাকে। নীচের ধাপে চারকোনে নৃত্যরত চারজন পরীর মূর্তি রয়েছে। কুলদেবতার পায়ে নূপুর থাকায় সামন্ত পরিবারের মেয়েরা কেউ পায়ে মল পরতেন না। তবে কালের নিয়মে এসব রীতি অনেকটাই হালকা হয়েছে।
জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর ভাই রমানাথ সামন্তের দুই ছেলে দুর্লভ সামন্ত এবং অমূল্য সামন্ত তাঁদের বাবা ও জেঠুর নামেই তিয়রবেড়িয়াতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুল বর্তমানে জগন্নাথপুর ত্রৈলোক্য রমানাথ উচ্চ বিদ্যালয়। রথের সময় এই স্কুলকেই মাসীবাড়ি করা হয়। রাস্তার সঙ্কীর্ণতার কারণেই রথের সময় বাদ্যযন্ত্র সহকারে পালকি করেই মাসীবাড়ি আনা হয় কূলদেবতাদের। রথের দিন পুজোর পর দুপুর থেকে স্কুলের সামনের মাঠেই আটচালাকে কেন্দ্র করে রথ তিনবার অথবা পাঁচবার ঘোরানো হয়। পুরীর মতোই উৎকল মতে ৯ দিনের দিনে এখানে উল্টোরথ হয়। এই ৯ দিন মাসি বাড়িতে মা ধুমধামে পুজো চলে। এবার আসি ভোগের ব্যাপারে বছরের বছরের প্রতিদিন মদনগোপাল কে কাঁচা আতপ চালের নৈবেদ্য দেয়া হয় এবং সন্ধ্যে দেওয়া হয় মিষ্টান্ন ভোগ এছাড়াও জন্মাষ্টমী রাস দোল চাঁচর রথযাত্রা একাদশীতে থাকে বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা এছাড়াও রথের ন’দিন মহা ধুমধামে পূজা করা হয়। সেই সময়ে ওই নয়দিন প্রতি সন্ধ্যায় অবশ্যই দেওয়া হয় খই মুড়কি গজা এবং মুগের জিলিপির ভোগ থাকে লুচি সুজি মিষ্টি ফল। এখানে একটি বিশেষ কথা রয়েছে মদন গোপাল জিউকে কখনো চালের ভোগ দেয়া হয় না। মানে রান্না করা চাল অন্ন হোক পায়েস হোক যাই হোক কোন কিছুই দেয়া হয় না। শুধুমাত্র দেওয়া হয় সুজির পায়েস। উল্টো রথের দিন মদন গোপাল জিউর বাড়ি ফেরার দিন মাসির দেওয়া খই চড়া ছড়িয়ে ছড়িয়ে কুল দেবতা বাড়ি ফেরেন। আর ওই একদিনই রাত্রে জমিদারের বসত বাড়িতে কিছু ক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কুলদেবতাকে।
কথিত আছে আগে নাকি কামান ফাটিয়ে রথ টানা হতো। এমনকি এই উৎসবের সময় আড়খানার শিবপুকুর থেকে মাছ ধরে আমিষ ভোজের ব্যবস্থা থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। একটা সময় তিয়রবেড়িয়াতে তালপাতার পেখ্যা বিখ্যাত ছিল। বৃষ্টি বাদলার দিনে পেখ্যার ব্যবহার ছিল বেশী। কালের নিয়মে সেসব এখন অতীত। এখনও মেলাতে মাদুর, চাঁচি, বাঁশের ঝুড়ি, কুলো, ঢুচনি, ঠ্যাকার পসরা বসে। রথের মেলায় জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, ঘুগনির দোকান যেমন রমরমিয়ে চলে তেমনি তিয়রবেড়িয়ার রথ মানেই হরেক রকমের ফুল ও ফলের চারাগাছ বিক্রির নার্শারী দোকান। প্রতিদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও রথযাত্রা ও উল্টোরথের দিন মানুষের ভিড় প্রমাণ করে দাসপুরের তিয়রবেড়িয়ার এই পিতলের রথের মাহাত্ম্য কোনো অংশে কম নয়।
আশেপাশের ১৫ থেকে ২০ টি গ্রামের মানুষ সামিল হয় এই রথযাত্রা উৎসবে এছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন দেখতে আসেন এই পিতলের রথ। প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার লোকের জমায়েত হয় এই মেলা প্রাঙ্গণে। আধুনিক সময় গ্রামীণ সভ্যতার অনেক পরিবর্তন ঘটালেও তিয়রবেড়িয়ার রথের মেলার উন্মাদনায় কোনোরকম ভাটা ফেলতে পারেনি।
তথ্য সূত্র :- সুমন সামন্ত
(প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্য )