কিছুটা স্বস্তির খবর শুনিয়েই বাড়ি পাঠানো হয়েছিল ছেলেটাকে। কিন্তু ভোর সকালেই আবার ছুটে চলে এসেছে। সকাল থেকে নার্সিংহোমের এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ঝাপ করছে। বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। কখন যে শোকের ছায়া মুখ থেকে উঠে গিয়েছে মনে নেই।
এই কয়েক ঘণ্টায় শুভর বয়স যেন কিছুটা বেড়ে গেল। সবই বুঝতে পারছি কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। গতকালই সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ কয়েকবার শুভকে বললাম যে একবার গাড়িটা নিয়ে তোর বোন শুভ্রাকে টিউশন থেকে নিয়ে আয়। মিনিট পাঁচেকের রাস্তা।
রাত্রিতে ছাড়ার সময় মেয়েটাকে আমিই রোজ বাড়ি নিয়ে আসি।
আজ অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না। কয়েকবার শুভকে বললাম ও যেন ওর বোনকে আনতে যায়।
কিন্তু কে শুনে কার কথা। কানে হেডফোন লাগিয়ে গেম নিয়ে পড়ে রয়েছে।
ভুলটা আমারই ওর মা বারবার বারণ করেছিল যাতে ফোনটা ওকে না দিই।
এবছর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে শুভ। রেজাল্ট বেরোতেও কিছুটা সময় বাকি। গত মাসে ও মামা বিদেশ থেকে এসে ফেরার সময় কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল। যাতে
সবাইকে কিছু কিনে দেওয়ার জন্য ওর বাবা থাকেন আমেরিকার টেক্স আছে ওখানেই প্রতিষ্ঠিত এক দুই বছর ছাড়া ছাড়া আসেন দেশের বাড়ি। সহজে প্রচুর ভালোবাসে এবার হঠাৎ চলে আসার কারণে শুভ ও শুভর বোনের জন্য সেভাবে কিছু নিয়ে আসেননি।
তাই কিছু কিনে দেওয়ার জন্য টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন । উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষের পর প্রচুর জেদাজেদিতেই এই ফোনের প্রাপ্তি ঘটে শুভর । বেশিরভাগ সময়টাই ফোন নিয়েই থাকে।বললেই বলে অনলাইনে কিছু ক্লাস দেখছিলাম।
প্রচুর বদমেজাজি। কথাও শোনে না। মুখে মুখে তর্ক লেগেই আছে। শুভ্রার টিউশন ছুটি হয় পৌনে নটা নাগাদ। এখন ঘড়িতেও প্রায় নটা বাজে। মেয়েটা হয়তো একাই অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য।
এদিকে শুভকেও বারবার বলেও সে কোনো কথায় কোন কান দেয় না।
রান্নাঘর থেকে ওর মা কয়েকবার তাগাদা দেয় তাতেও কাজ হয় না।
শরীরটা খারাপ লাগা সত্ত্বেও একেবারে বাধ্য হয়েই বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মেয়েকে নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ একটা পিকআপ ভ্যানের আলোতে কোন রাস্তা দেখতে না পেয়ে গাড়িটা তিনমাথা মোড়ে একটা ইলেকট্রিক খুটিতে ধাক্কা মেরে মাটিতে লুকিয়ে পড়লাম।
তারপর নার্সিংহোমের এই বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম।
শরীরটা অবশ হয়ে রয়েছে। ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মেয়েটা প্রচন্ড ভালবাসে আমাকে। অফিস থেকে ফিরলে প্রতিদিন জামা কাপড় গামছা সমস্ত বিছানায় হাতের কাছে নিয়ে রেখে দেয়।
সাথে এক গ্লাস জল। প্রতিদিন বেরোনোর সময় বলে যে সাবধানে যেও বাপি।
সেই মেয়েটা আজ ফুপিযে ফুপিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
শুভ্রার মুখটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
কিছু খেয়েছে কিনা কে জানে? বারবার ডাকছি তবু কেন শুনতে পাচ্ছে না।
দুপুরের পর থেকে ছেলেটা আত্ম গ্লানিতে ভুগছে বারবার নিজেকে দোষারোপ করে মনে মনে বলছে যদি আমি বোনকে আনতে চলে যেতাম তাহলে আজ হয়তো এই ঘটনা ঘটত না । আমারই ভুল কেন যে তখন বাবার কথা শুনলাম না? তাহলে এই ঘটনা দেখতে হতো না।
মাথাটা আজ ভীষণ রকম ধরে আছে। আর সমস্ত শরীর যেন অবশ। সবই দেখছি চোখের সামনে। সমানে ডাকছি , কেউ শুনতে পাচ্ছে না।
ছেলেটি তার বোনকে ধরে আঁকড়ে কাঁদছে। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি আমি বিছানাতে আছি আর আমি শরীর ও সমস্ত বিছানা ঘামে ভিজে গিয়েছে।